কিছুক্ষণ আগেই ঘরে বাজছিল অঞ্জন দত্তের গান। বেলা বোসের সেই গান যেই গানে প্রেম, অপেক্ষা, স্বপ্নবুননের গল্প। আমরা প্রায়ই অঞ্জন দত্তের মেরি অ্যান, একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে, বেলা বোস, রঞ্জনার গান শুনে সেই ছোটবেলায় ফিরে যাই। হঠাত মনে হলো, আমরা কতশত গানের স্মৃতি আউড়াই, গুনগুন করি। আমাদের মেয়েটা মাথা দুলায় দুলায় ‘আমি একটা পাতার ছবি আঁকি’ গাইতো আরো এক বছর আগে থেকে। কিন্তু কুড়ি বছর পর গিয়ে এখনকার কোন গানটা গুনগুন করে গাইবে ও? এখন কি এখন মনে রাখার মতো কোনো দুর্দান্ত গান হচ্ছে?
গান ছাড়া জীবনকে কল্পনা করে দেখুন তো? সম্ভব না। গান শুধু বিনোদনের মাধ্যম না। গান আমাদের আবেগ, চিন্তা ও সংস্কৃতির সঙ্গী। গান মনে শান্তি আনে, দুঃখ চাপ কমায়। ওপার বাংলায় তাও কিছু ভালো গান কখনো আসে। কিন্তু দেশে বাংলা গানের বড় আকাল চলছে বহুদিন ধরেই।
দেশে কোক স্টুডিওর কল্যাণে কিছু গান ফিরে এসেছে বা মৌলিক কিছু গান হচ্ছে। এর বাইরে তেমন কোনো ভালো গান কই?
উল্লেখ করার মতো দেশে ভালো কোনো ব্যান্ডদল নেই যাদের গান বারবার শোনা যায়। এলআরবি, নগরবাউল, আর্ক, সোলস, রেনেসাঁ, মাইলস, ফিডব্যাক, ওয়ারফেইজ, দলছুট, শিরোনামহীন, অর্থহীন- এই নামগুলো আমাদের জীবনের পরমপ্রাপ্তির। মনে পড়ে, যেদিন আইয়ুব বাচ্চু চলে গেলেন, আমি অফিসে নির্বাক বসেছিলাম। তার প্রয়াণের সংবাদ লেখার সময় নিজেরই অবিশ্বাস্য লাগছিল সব। এখন যখন হাসতে দেখো গাইতে দেখো গান গুনগুন করি, মনে হয় জীবনের সাথে সব মিলে যাচ্ছে। আমার বড়ভাই গানপাগল মানুষ ছিল কৈশোরে। তার কারণেই অনেক গানের সাথে পরিচয়।
আমরা একটা প্রজন্ম বড় হয়েছি হাবিব ওয়াহিদের গান শুনে। হাবিবের গানের যেই ক্রেজ এখন পর্যন্ত চলমান, তা নতুন কোনো শিল্পীর মাঝে নেই। হাসানের সুইটি, মাইলসের নীলা, পার্থ বড়ুয়ার আমি ভুলে যাই তুমি আমার নও, তুহিনের সারাবেলা বন্ধ জানালা গানগুলো ভরা আমার জীবনের অসংখ্য স্মৃতি।
অর্ণবের ভালোবাসা তারপর, নাম ছিল না, তোমার জন্য নীলচে তারা, কেন চলে গেলে দূরে… এই গানগুলো কি আসবে আর? বাপ্পা মজুমদারের দিন বাড়ি যায়, পরী, বায়ান্ন তাস শুনেছি সেই ছোটবেলা থেকে। তিনিও আর এখন নতুন কোনো গান নিয়ে আসেন না। ভাইয়ের একটা ক্যাসেটে বাপ্পার ‘ধুলো মাখা চিঠি’ আমি লুকিয়ে লুকিয়ে শুনতাম।
বহুদিন তাহসান, মিনার, হৃদয় খানের নতুন কোনো গান শুনিনি। তাহসান আর মিথিলার ডুয়েট গানগুলো তখনকার প্রেমিকযুগলদের জন্য অন্যরকম রসদ ছিল। মিনারের ‘সাদা’ গানটা আমাকে নিয়ে যেত অন্য এক দুনিয়ায়। বালাম, আরেফিন রুমির দেখাও পাওয়া যায় না তেমন। মেহেরিনের ‘তুমি আছো বলে’ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমি প্রচুর শুনেছি।
কিছুদিন আগেই খালিদ চলে গেলেন। তার সেই সরলতার প্রতীমা, যদি হিমালয় হয়ে, কোনো কারণে ফেরানো গেল না তাকে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এই গানগুলোর জন্য পাগল।
এখন ভালো গান মানেই সেইটা ভাইরাল কোনো গান। আর চলচ্চিত্রে ভালো গান মানে বলিউড, টালিউড স্টাইলে আইটেম গান। সাম্প্রতিককালে যদি ভালো আইটেম গানের কথা বলা হয় তাহলে মনে আসে দুষ্টু কোকিল ধরনের গানের কথা। খুব ভাইরাল হলো এই গানটা। শুনতে ভালো লাগলো কিনা জিজ্ঞেস করলে বলবো গান শুনে হাসি আসছে, গুনগুন করে তো এই গান গাওয়া হয়নি কখনো। এখন এমন অনেক দুষ্টু কোকিল ধরনের দুষ্টু গান হচ্ছে, এতে চলচ্চিত্রও হিট হচ্ছে।
আমাদের মা-বাবা এবং পরবর্তীতে আমাদের পছন্দের তালিকায় আরও ছিল শাকিলা জাফর, সামিনা চৌধুরী, ফাহমিদা নবী, তপন চৌধুরীর মতো শিল্পীরা আর তাদের আধুনিক গান। তুমি আমার প্রথম সকাল, কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে গানদুটো শুনলে আমি অতীতে চলে যাই। মনে হয় প্রেম প্রকাশের ধরণ কত দারুণই না ছিল! ইত্যাদি অনুষ্ঠানে কিছু মৌলিক গান হতো, সেগুলো আজও জনপ্রিয়।
ঈশানের দুটো গান চলেছে ভালো, লেগেছে ভালোও। নিঠুর মনোহর আর গুলবাহার গানদুটো তৃপ্তি এনে দিয়েছে।
এখনকার গানগুলো খুব অল্পদিন মনে থাকে, তারপর ভুলে যাই। কারণ ভালো কোনো সুর, ছন্দ, কথা নেই গানে। আগে কত সুন্দর মিউজিক ভিডিও দেখতাম, এখন আর রুচিকর মিউজিক ভিডিও দেখি না। চলচ্চিত্রের গানেও ভাটা পড়েছে। এখন সবাই গান খোঁজে রিলস বানানোর জন্য।
সবশেষে একটা কথা মনে আসছে। আমার স্যামসাং এর একটা সুন্দর বাটন ফোন ছিল। একজন ছোট ভাইকে দিয়ে মেমোরিকার্ডে গান নিয়েছিলাম। তার মধ্যে ছিল আলো, সাদা রঙের স্বপ্ন, বৃষ্টি ঝরে যায় দুচোখে গোপনে, চাই না মেয়ে, যদি ডেকে বলি এসো হাত ধরো… এরকম অনেক গান। এফএম রেডিওতে গান শোনার জন্য পাগল ইয়ে থাকতাম। এখন নতুন করে শোনার মতো আর গান পাই না। আমি জানি না গান হারিয়ে যাওয়ার এই আফসোসটা আর কারো হয় না, আমার হয়, প্রবলভাবে।


Leave a Reply