অলসতা দিন দিন কেন এত বাড়ছে আমাদের, এটা নিয়ে লিখবো ভাবছি অনেকদিন। কিন্তু লেখা আটকে গেল এই অলসতার কারণেই। ডুবে গিয়েছিলাম অলসতায়। লিখবো লিখবো করেও হচ্ছিলো না।
একজনকে বলতে শুনেছিলাম তার নাকি ‘ল্যাদ লাগছে’। মানে কিচ্ছু করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আমারও হয় এমন। সারাদিন হাই তুলে, ঝিমিয়ে কাটাতে ইচ্ছে করে। তখন ভাবলাম আমাদের সবারই কি এমনটা হয়? সব কাজ ফেলে কি শুধু আরাম করতে ইচ্ছে করে? প্রথমে নিজেকে দিয়েই অনুসন্ধান করলাম। প্রশ্ন করলাম কেন এত গড়িমসি করি সব কাজে? অনেকগুলো বিষয় মনে মনে তালিকা করলাম।
দরকারি কাজ ফেলে রেখে আসলে আমি তখন কি করি? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফোনটা হাতে নিয়ে শুয়ে-বসে অলস সময় কাটাই। তখনই বুঝলাম এই অলসতার পিছনে প্রযুক্তি অনেকটা দায়ী, বিশেষ করে এই মোবাইল ফোনটা।
প্রতিদিন গড়ে কয়েকঘণ্টা মানুষ ফোনে কাটায় কারণ ছাড়া অকারণেই বেশি। ফোন আলাদা একটা দুনিয়া মেলে ধরেছে আমাদের সামনে। দিনে সময়ের বড় অংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, গেমস, শর্ট ভিডিও বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে চলে যাচ্ছে। বসে বা শুয়ে স্ক্রল করতে করতে মানুষ সাধারণত শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয় হচ্ছে।
এছাড়াও আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অত্যন্ত সক্রিয়। অনলাইন বন্ধুদের সাথে কথা বলা, ছবি বা ভিডিও শেয়ার করা, কিংবা বিভিন্ন গ্রুপে অংশ নিয়ে ভার্চুয়াল জগতে আমরা সক্রিয় হলেও বাস্তব জীবনে এর প্রভাব ভিন্ন।
একটানা মোবাইল বা কম্পিউটারের সামনে বসলে শারীরিক নড়াচড়া কমে যায়। হাঁটা, খেলাধুলা, ব্যায়াম, বাইরে সামাজিকভাবে মেলামেশার প্রবণতা কমছে। এর পরিবর্তে ভার্চুয়াল চ্যাটিং ও অনলাইন স্ক্রলিং মানুষকে আরও বেশি নিস্ক্রিয় করে দিচ্ছে। ফলে বাস্তবজীবনে কর্মচঞ্চলতা কমছে, বাড়ছে অলসতা।
শারীরিকভাবে বাড়ছে স্থূলতা, পিঠব্যথা, চোখের সমস্যা। হচ্ছে ঘুমের ব্যাঘাত। আর মানসিকভাবে মনোযোগে ঘাটতি হচ্ছে। সৃজনশীলতা কমে যাচ্ছে, হতাশা বাড়ছে।
তাছাড়া সামাজিকভাবেও প্রভাবিত হচ্ছি আমরা। কাছের মানুষদের সাথে মেলামেশা কমে যাচ্ছেন, দুরত্ব তৈরি হচ্ছে। আগে মানুষ খেলাধুলা বা আড্ডায় সময় কাটাতো, বেড়াতে বের হতো। এখন গুটিয়ে নিচ্ছি নিজেদের।
এবার বলি কর্মক্ষেত্রের বিষয়ে। অফিসের কাজ, ফ্রিল্যান্সিং, রিমোট জব- অধিকাংশই কম্পিউটারের সামনে বসে করতে হয়। এ যেন এক শারীরিক নিস্ক্রিয়তা।
এছাড়া আমাদের দৈনন্দিন ব্যস্ততা এতই বেশি যে নিয়মিত শরীরচর্চার সুযোগই বা আমাদের কই! শরীরচর্চা বা খেলাধুলা না করলে শরীর ধীরে ধীরে অলস হয়ে পড়ে। নগরজীবনে মাঠ বা ব্যায়ামের পরিবেশের অভাব এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে।
দিন যত যাচ্ছে, জীবনযাপন কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছেই। মানসিক চাপ জাতির জন্য ভয়াবহ এক হুমকি। অতিরিক্ত চাপে ক্লান্তি নেমে আসে মনে আর শরীরে। শিক্ষাজীবন, কর্মক্ষেত্রের প্রতিযোগিতা বা ভবিষ্যতের চিন্তায় মানসিক ক্লান্তি তৈরি হয়। মুষড়ে পড়তে পড়তে কোনো কাজে আর উদ্যম পাই না আমরা। জীবন লক্ষ্যহীন বা প্রেরণাহীন হলেও নিস্ক্রিয়তা চলে আসে। সামনের দিনগুলো নিয়ে কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও সময় অলসভাবে নষ্ট হবেই।
আধুনিক নগরজীবনে ‘কমফোর্ট লাইফস্টাইল’ বলে একটা ব্যাপার আছে। যেটাকে আরামপ্রিয়তা বলি আমরা। জীবনকে সহজ করে তুলেছি আমরা নিজেরাই। ঘরের বাইরে বের না হয়েও খাবার অর্ডার করা, বিল পরিশোধ, কেনাকাটা কিংবা বিনোদনের সব পাওয়া যাচ্ছে মাত্র কয়েকটি ক্লিকেই। পদ্ধতি যত সহজ, আমরা তত আরামপ্রিয়। অলস তো হবোই!
অলসতার পিছনে আরেকটি প্রভাবক হলো স্বাস্থ্যগত বেশকিছু ইস্যু। স্থূলতা, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, ডিপ্রেশন বা ঘুমের সমস্যা থেকেও অলসতা দেখা দেয় প্রকটভাবে। শারীরিক অসুস্থতাকে প্রশ্রয় দিয়ে অলসতাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচি সবসময়।
অলসতার অন্যতম একটা কারণ যে অতিরিক্ত জাঙ্ক ফুড, ফাস্টফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়া, সেটা বিশ্বাসই হতো না। এই খাবারগুলো শরীরকে দ্রুত ক্লান্ত ও নিষ্ক্রিয় করে তোলে। এই কারণে প্রচুর আলস্য ভর করে।
সেই ছোটকাল থেকে শুনে এসেছি অলস মস্তিস্ক শয়তানের কারখানা। আসলেই তাই। এটা অতিবাস্তব কথা। শরীর আর মনকে অলস করে ফেলার কারণে নিজের ধ্বংস নিজেরাই ডেকে আনি। বলা হয় আলস্য দোষের আকর। অর্থাৎ শারীরিকভাবে অসুস্থতা, মানসিকভাবে অবসাদ, সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া—সবই আলস্যের কারণে ঘটে। তাই যতই আলস্য ভর করুক, যেভাবে হোক সময়ের কাজ সময়ের মধ্যে করে ফেলা এমন কঠিন তো নয়। চাইলেই জীবনকে একটি ছকে বেধে নেওয়া যায়। শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিকভাবে উদ্যমী হতেই হবে, নয়তো এই কঠিন সময়ে টিকে থাকা তো মুশকিল।
Leave a Reply