শুরু থেকে আজ অব্দি সুরের মহাজাদুকর হাবিব ওয়াহিদ

জাদু শিরোনামের গান আসছে দেখে মনে হয়েছিল তিনি বুঝি নিজের সেই ‘জাদু’ গান নিয়ে ফিরে আসছেন। ‘মেয়ে তুমি তো আমার নও চেনা…’ এই কথা দিয়ে গানটা যখন শুরু হয়, মন সুরের তালে ভাসতে থাকে। কিন্তু না, তিনি এলেন ‘মহাজাদু’ নিয়ে। ফার্সির ছোঁয়ায় এক অনন্য মাত্রা পেল কোক স্টুডিও বাংলার তৃতীয় সিজনের ষষ্ঠ গান ‘মহা জাদু’।

তাকে যদি সঙ্গীতের একজন জাদুকর বলি তাহলে ভুল হবে না। সে যে আসলেই জাদুকর তার প্রমাণ মিলেছে কয়ঘণ্টা আগেই, ‘আমার বন্ধু মহা জাদু জানে’ গানের মাধ্যমে। আমি বলি হাবিব ওয়াহিদ আসলেই জাদু জানেন। হাবিব মানেই ক্রেজ!

এই গান শুনতে শুনতে হারিয়ে গিয়েছিলাম তার ‘কৃষ্ণ’ গানের আবহে। মনে হচ্ছিলো সেই সুরটাই শুনছি একটু অন্যরকম ঢঙে। আমাদের ঘরে নোকিয়া ১১০০ ফোনে কৃষ্ণ’র রিংটোন বেজেছে বহুদিন। লোক ও আধুনিক সুরের মিশ্রণ বা ফিউশন জমেই হাবিবের হাতে।

আমি গানটির নিচের বিভিন্ন কমেন্ট দেখছিলাম। হাবিব ওয়াহিদের যে এত এত ফ্যান এই গানের অপেক্ষা করে ছিল, আমি বিষ্ময় নিয়ে তা দেখলাম। কেউ বলছেন রাজাকে রাজার মতো করেই উপস্থাপন করা হইছে। আরেকজন লিখেছে হাবিব ওয়াহিদের ভোকাল মানেই আগুন, হাবিব মানেই বাংলা গানের অক্সিজেন। অনেকে নষ্টালজিয়া প্রকাশ করছেন। এদের বেশিরভাগ আমাদের প্রজন্মের। কেউ সিডি কিনে তার গান শোনার স্মৃতি মনে করছেন। কেউ পুরনো প্রেমের স্মৃতি রোমন্থন করছেন।

এত বছরেও হাবিব বা তার গানের কদর একটুখানিও কমেনি। আমি নিজেও তার সমকক্ষ আর কাউকে কখনো ভাবিইনি! হাবিব-ন্যান্সির জুটি আমাদের কাছে সুপারহিট। দ্বিধা, পৃথিবীর যত সুখ, হাওয়ায় হাওয়ায় দোলনা দোলে, ঝরা পাতা উড়ে যায়, আমি তোমার মনের ভিতর, হৃদয়ের কথা… এই গানগুলো কি আজও সমান জনপ্রিয় নয়?

একসময়ে আমার বাটন ফোনের প্লেলিস্টে ছিল হাবিবের গান দিয়ে ভরপুর। বলছি তোমাকে, বেপরোয়া মন, বলো কেন এমন হয়, ভালোবাসবো বাসবো রে, ঘুম, চলো না, পথ হয়ে যায় নদী- আরো কত গান মনে করতে করতে দিন পেরিয়ে যাবে। শুধু গান সুর বা গাওয়া নয়, মিউজিক ভিডিও জগতেও হাবিব ওয়াহিদের জয়জয়কার। সর্বশেষ তার ‘বেণি খুলে এলো চুলে’ গানে আবার হারিয়ে যেতে দেখেছি এই প্রজন্মকে।

আমি প্রথম প্রিয় এই মানুষটাকে চিনি ‘দিন গেল’ গানের মাধ্যমে। কিবোর্ড নিয়ে দাঁড়ায় ‘সহে না যাতনা তোমারো আশায় বসিয়া’ গাচ্ছে একমনে, স্নিগ্ধ প্রেমের আহবানে। এরপর হাবিবের গানের সাথে পরিচিতির আরেকটা গল্প আছে। এই গানটি লিখেছিল খুলনার একজন মেয়ে, নাম সুস্মিতা বিশ্বাস সাথী। আমিও তখন খুলনার স্কুলে পড়ি। যতদূর শুনেছিলাম সেই মেয়েটিও আমার স্কুলেই পড়তো। কি অদ্ভুত লাগতো, মনে হতো আমি কি কখনো এমন করে গান লিখতে পারবো!

হুমায়ুন আহমেদের মতো কালজয়ী লেখকও হাবিবের কদর করতে ভোলেননি। তার আমার আছে জল চলচ্চিত্রে ‘বাদলা দিনে মনে পড়ে’ গানের সুরস্রষ্টা হাবিব নিজেও গানটি গেয়েছেন। বৃষ্টির মুহুর্তে এই গান শুনলে মনে কাঁপন ধরে। ছেলেবেলা, কৈশোরের অনেক বৃষ্টিদিনের মন খারাপের স্মৃতি ভাসে।

হাবিব ওয়াহিদ তার বাবার জনপ্রিয়তাকেও ছাপিয়ে গেছেন। সবচেয়ে ভালো লাগে যে নিজের হাতে বাবার জন্য গান কম্পোজ করছে হাবিব। বাবা ফেরদৌস ওয়াহিদ হাসিমুখে সেই গান গাইছেন। প্রজাপতি চলচ্চিত্রে হাবিবের সুরে কুমার বিশ্বজিতের গাওয়া ‘ছোট ছোট আশা খুঁজে পেল ভাষা’ গান আমি যে কত্তবার শুনেছি, হিসেব নেই। ওই চলচ্চিত্রেরই ‘ডুব’ শিরোনামের ‘তোমার মাঝে নামব আমি, তোমার ভেতর ডুব’ গানে প্রেমের যে আবেদন তা বারবার কোনো গানে ফিরে আসে না।

গান তো গেলো, এবার জিঙ্গেলের কথায় আসি। হাবিব এ পর্যন্ত অগ্ণিত বিজ্ঞাপনে কণ্ঠ আর সুর দিয়েছেন। বাংলালিংকের ‘শুনতে কি পাও…’ জিঙ্গেলটি বহুদিন আমার ফোনের ওয়েলকাম টিউন ছিল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের আগে।

আমার মা’কেও দেখেছি হাবিবের গানের অন্যরকম ভক্ত আজ পর্যন্ত। ‘তোমারে দেখিলো নয়নও ভরিয়া’ গান আমাকে বারবার বাজিয়ে শোনাতে বলতেন।

কণ্ঠ, গায়কী, সুর, গানের ছন্দ কোনোকিছুতেই তাকে ছাড়ানো সম্ভব না। তার সঙ্গীতজীবন স্বার্থক এবং বর্ণাঢ্য। তার শ্রোতামহল টিকে থাকবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। মহাজাদুকরের আরও জাদুকরী গানের অপেক্ষায় রইলাম আমরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *