শরীরে কোনো রোগ বাসা বাধলে আমরা চিন্তিত হই। চিকিৎসা করাই, ডাক্তারের কথামতো চলি, ওষুধপথ্য খাই, নিয়ম মেনে চলি। কিন্তু মনে কোনো রোগ হলে আমরা সেটা টেরই পাই না। যত্নআত্তি তো দূরে থাক।
শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়াও সমান জরুরি, যেটা আমরা অনেকেই জানি না। বিভিন্ন রোগের বিশেষজ্ঞদের কাছে আমরা নিয়মিতই যাই, মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে আমরা কয়জনই বা যাই!
কিছুদিন আগে একজন প্রবীণ সংবাদকর্মী আত্মহননের পথ বেছে নেন। তিনি বিভুরঞ্জন সরকার। মায়াবী মুখের একজন মানুষ। একটি নোট লিখে তিনি এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছেন। যেই নোটে অসংখ্য কষ্টের কথা লিখেছেন। জীবনের সাথে যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়ে চলে গেলেন। মানসিকভাবে প্রচণ্ড অসুখে ছিলেন তিনি। সেটা হয়ত আশেপাশের কেউই জানতো না। এরকম ঘটনা আরও অনেক আছে।
আমি একজন সহকর্মীকে জানতাম, তিনি পারিবারিক কিছু জটিলতার কারণে বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভুগতেন। বিষণ্নতা, নিদ্রাহীনতা, মনোযোগের অভাব তার মধ্যে স্পষ্ট ছিল। তাকে একদিন বললাম একজন মনোরোগ চিকিৎসকের সাথে কথা বলতে। সে বললো সে একদমই পাগল নয়, মনের ডাক্তার দেখানও তো একরকমের বিলাসিতাই মনে হয় তার কাছে। সে হাসতে হাসতেই আমাকে বললো, পাবনা (মানসিক হাসপাতাল) যাওয়ার মতো অবস্থা তার একদমই হয়নি।
অর্থাৎ মানসিক সমস্যাকে স্বাভাবিকভাবে নেয় না বেশিরভাগ মানুষ। কিন্তু, মানসিক স্বাস্থ্য কোনো বিলাসিতা নয়, এটি জীবনে জরুরি, এটা মানতে নারাজ আমরা। অনেকে ভাবেন মানসিক ডাক্তার দেখানো মানে বুঝি পাগলের ডাক্তার দেখানো। মানে মনের রোগ বা অস্থিতিশীলতা হলো পাগল হয়ে যাওয়ার সামিল।
মনের স্বাস্থ্যকে ঠিকঠাক রাখার দায়িত্ব বেশিরভাগটা আমাদের নিজেদের। মানসিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার কিছু লক্ষণ তো রয়েছেই। যেমন দীর্ঘমেয়াদী ডিপ্রেশন, মানসিক চাপ, কোনো কাজে মনোযোগের অভাব, ঘুম কমে যাওয়া আরো কত কি!
মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির কিছু কারণ জানি আমরা-
- অতিরিক্ত মানসিক চাপ
 - সম্পর্কের টানাপোড়েন বা একাকীত্ব
 - দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক অসুস্থতা মানসিকতাকে নষ্ট করে দেয়।
 - অতীতের আঘাত বা ট্রমা
 - অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন- যেমন ঘুমের অভাব, অনিয়মিত খাবার, মাদক বা ধূমপানের অভ্যাস, ব্যায়ামের অভাব মন ও শরীরের ভারসাম্য নষ্ট করে।
 - নিজেকে তুচ্ছ ভাবা, সবসময় অন্যের সঙ্গে তুলনা করা, ব্যর্থতার ভয় মানসিক স্বাস্থ্যে বড় প্রভাব ফেলে।
 - বেকারত্ব, আর্থিক সংকট, সমাজে বৈষম্য বা নিরাপত্তাহীনতা মানসিক চাপ বাড়ায়।
 
এবার মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার উপায়গুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক-
প্রতিদিন নিজের জন্য কিছু সময় রাখতে হবে। শুধু নিজের কথা ভাবা কঠিন হলেও ভাবতে হবে। পছন্দের কাজ করা যায়, যেমন বই পড়া, গান শোনা, হাঁটাহাঁটি, বা প্রকৃতির মাঝে সময় কাটানো। নিজের মনে গান গাওয়া, ছবি আঁকা, মুভি দেখা যেতে পারে।
নিজের দুঃখ, ভয় বা চিন্তা একা পুষে রাখা উচিৎ নয়। খুব কাছের বিশ্বাসযোগ্য কারও সঙ্গে কথা বললে চাপ কমে, মন হালকা হয়। প্রয়োজনে কাউন্সেলর বা মনোবিজ্ঞানীর সাহায্য নিন।
নিজেকে দোষারোপ না করে নিজের সীমাবদ্ধতা মেনে নিন।
ঘুম খুব জরুরি। প্রতিদিন অন্তত ৭–৮ ঘণ্টা ঘুমান। নিয়মিত ও পরিমিত খাবার খান যেমন ফল, শাকসবজি, পানি ও প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্য মানসিক ভারসাম্য রক্ষা করে।
প্রতিদিন অন্তত ২০–৩০ মিনিট হাঁটুন বা হালকা ব্যায়াম করুন।
সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখুন, প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটান। সমাজে অংশগ্রহণ করুন, অন্যকে সাহায্য করুন। এতে আত্মতৃপ্তি বাড়ে।
অতীতের ভুলভ্রান্তি কাটিয়ে বর্তমানে মন দিন। নিজের ছোট ছোট সাফল্যকেও উদযাপন করুন। নিজের জন্য, অন্যের জন্য উপহার কিনুন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অভ্যাস কমাতে হবে। বেশি সময় স্ক্রিনে কাটালে মন ক্লান্ত হয় ও আত্মবিশ্বাস কমে। এই মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময় ব্যবহার করুন। নেতিবাচক বা তুলনামূলক বিষয় এড়িয়ে চলুন।
যদি দীর্ঘ সময় ধরে হতাশা, ভয় বা দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি না মেলে তাহলে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতেই হবে। আর একটি জরুরি বিষয়, নিজের পাশাপাশি আশেপাশে বাস করা প্রতিটি মানুষের মনের দুরাবস্থায় তাদের সমব্যাথী হোন। তাদের পাশে থাকুন। কোনো মানুষই যেন মনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত হয়ে এ পৃথিবী থেকে হারিয়ে না যায়।


Leave a Reply